
হীরা—এই শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মূল্যবান, চকচকে এবং দুর্লভ এক রত্নের ছবি। পৃথিবীতে আমরা নানা আকারের হীরা দেখেছি, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ‘গোল্ডেন জুবিলি’। কিন্তু যদি বলি, মহাকাশে এমন এক হীরা আছে যার কাছে গোল্ডেন জুবিলি কিছুই নয়? হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা এমনই এক বিশাল মহাজাগতিক হীরার সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে “লুসি”!
লুসি আসলে কী?
লুসির আসল পরিচয় হলো এটি একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র (White Dwarf Star)। এর বৈজ্ঞানিক নাম BPM 37093, যা V886 Centauri নামেও পরিচিত। এই নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৫০ আলোকবর্ষ দূরে সেন্টোরাস (Centaurus) নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। শ্বেত বামন নক্ষত্রগুলো মূলত মৃত নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশ। যখন একটি মাঝারি আকারের নক্ষত্র তার জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন এটি সংকুচিত হয়ে একটি অত্যন্ত ঘন বস্তুতে পরিণত হয়। লুসির ক্ষেত্রে, এর অভ্যন্তরের কার্বন পরমাণুগুলো প্রচণ্ড চাপ এবং তাপে কেলাসিত (crystallized) হয়ে হীরায় রূপান্তরিত হয়েছে। সহজ কথায়, লুসি হলো একটি আস্ত হীরার তৈরি নক্ষত্র!
আকারে এবং ওজনে অবিশ্বাস্য!
বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, লুসির ব্যাস প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার। যদিও এটি আমাদের চাঁদের ব্যাসের (প্রায় ৩৪৭৪ কিমি) চেয়ে সামান্য বড়, কিন্তু এর ভর এবং ঘনত্ব অবিশ্বাস্য। এর ওজন অনুমান করা হয় ১০ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ক্যারেট (অর্থাৎ ১০ এর পরে ৩৪টি শূন্য বসালে যা হয়)!
ভাবুন একবার, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক হীরা, গোল্ডেন জুবিলি, যার ওজন মাত্র ৫৪৫.৭৬ ক্যারেট এবং আকার একটি গল্ফ বলের চেয়ে সামান্য বড়। তার তুলনায় লুসি কত বিশাল! এই মহাজাগতিক হীরাটি সত্যিই প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
বিজ্ঞানের চোখে লুসির গুরুত্ব
লুসির আবিষ্কার মহাকাশ বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমরা আগে থেকেই জানতাম যে পৃথিবীতে হীরা পাওয়া যায় এবং উল্কাপিণ্ডের নমুনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানো-হীরার সন্ধানও মিলেছে। কিন্তু লুসির আবিষ্কার প্রমাণ করে যে নক্ষত্রের অভ্যন্তরেও বিলিয়ন বিলিয়ন ক্যারেটের হীরা তৈরি হতে পারে। এটি নক্ষত্রের বিবর্তন এবং মহাবিশ্বের গঠন উপাদান সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এরকম আরও অনেক ‘হীরার নক্ষত্র’ মহাকাশে ছড়িয়ে থাকতে পারে।
শেষ কথা
লুসি শুধু একটি মহাজাগতিক বস্তুই নয়, এটি মহাবিশ্বের অপার রহস্য এবং সৌন্দর্যের প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবী ছাড়িয়েও বহু দূরে এমন অনেক বিস্ময় লুকিয়ে আছে যা আমাদের কল্পনারও অতীত। ১০ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ক্যারেটের এই মহাকাশীয় হীরাটি যেন অনন্ত মহাকাশের বুকে এক চিরস্থায়ী দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে।